ইতিহাসের পাতায় তিনি শিল্প-রসায়ন ও ভারতীয় রসায়নের জনক। খুব সাদামাটা জীবন ছিল তার। জমিদার বংশের সন্তান হয়েও তার সাদাসিধে জীবনযাপন দেখে অনেকেই অবাক হয়ে যেতেন।
তখন চলছে বৃটিশদের রাজত্ব । কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের দোতলার দক্ষিণ-পশ্চিম কোনের একটি কক্ষ। আসবাবপত্রের মধ্যে একটি খাটিয়া, দুটি চেয়ার, ছোট একটি খাবার টেবিল, একটি পড়ার টেবিল ও জামাকাপড় রাখার একটি সস্তা আলনা। পড়নে থাকত কম দামের মোটা খোটা ধুতি, চাদর, গেঞ্জি অথবা গায়ে একটি কোট। এক রাশ দাড়িগোফ মুখে লোকটির চুলে বোধকরি চিরুনি পড়েনি।
সকালে মাত্র এক পয়সার নাস্তা। এক পয়সার বেশি নাস্তা হলে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতেন। অনান্য খাবারদাবারও খুব সাদামাটা। অথচ তখন মাসিক আয় হাজার টাকার উপরে। মোট আয় থেকে নিজের জন্য মাত্র ৪০ টাকা রেখে বাকি সব দান করে দিতেন। এই মহান মানুষটিই আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, যিনি পি সি রায় নামে পরিচিত।
পি সি রায় শুধু বিজ্ঞানীই ছিলেননা। তিনি ছিলেন একজন শিল্পাদ্যোক্তা, সমাজ সংস্কারক, বিজ্ঞানশিক্ষক, দার্শনিক, কবি, শিক্ষানুরাগী, ব্যবসায়ী ও বিপ্লবী দেশপ্রেমিক। তিনি নিজেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন এইভাবে ‘আমি বৈজ্ঞানিকের দলে বৈজ্ঞানিক, ব্যবসায়ী সমাজে ব্যবসায়ী, গ্রাম্য সেবকদের সাথে গ্রাম সেবক আর অর্থনীতিবিদদের মহলে অর্থনীতিজ্ঞ।’ দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য যখন যা প্রয়োজন, সেটাই তিনি করেছেন।
খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার রাঢ়ুলি গ্রাম। যার পাশ দিয়েই বয়ে গিয়েছে কপোতাক্ষ নদ। ১৮৬১ সালের ২ আগস্ট (বাংলা ১২৬৮ সালের ১৮ শ্রাবন) এই রাঢ়ুলি গ্রামেই পি সি রায়ের জন্ম। বাবা হরিশচন্দ্র রায় ছিলেন স্থানীয় জমিদার। তার মায়ের নাম ভূবনমোহিনী দেবী। বাবা তাকে ডাকতেন ফুলু বলে। ছোটবেলায় মায়ের নিকট শিক্ষার হাতেখড়ি, পরে পড়াশোনা শুরু হয় বাবার প্রতিষ্ঠিত এম ই স্কুলে। চার বছর গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনার পর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কলকাতায় চলে যান। বাবার আগ্রহে ১৮৭২ সালে তিনি কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন কিন্তু রক্ত আমাশয়ের কারণে তার পড়ালেখায় ব্যাপক বিঘ্নের সৃষ্টি হয়। বাধ্য হয়ে তিনি নিজ গ্রামে ফিরে আসেন। এই ফিরে আসা তার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে উঠে। এই সময় পিতা হরিশ চন্দ্র রায়ের লাইব্রেরীতে পড়াশুনা করে পৃথিবীর জ্ঞান ভান্ডারের সন্ধান পান।
পি সি রায়ের পৈতৃক নিবাস
১৮৭৪ সালে প্রফুল্লচন্দ্র আবার কলকাতায় ফিরে অ্যালবার্ট স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকেই ১৮৭৮ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন কলেজে (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ) ভর্তি হন। ১৮৮১ সালে সেখান থেকে এফ এ পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন।
প্রেসিডেন্সি থেকে গিলক্রিস্ট বৃত্তি নিয়ে তিনি স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যান। এখানে তিনি বি এস সি পাশ করেন এবং ডি এস সি ডিগ্রী লাভের জন্য গবেষণা শুরু করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিলো `অন পিরিয়ডিক ক্লাসিফিকেশন অফ এলিমেন্টস`। দুই বছরের কঠোর সাধনায় তিনি এই গবেষণা সমাপ্ত করেন এবং ১৮৮৭ সালে পি এইচ ডি ও ডি এস সি ডিগ্রী লাভ করেন। তার গবেষণাপত্রটি শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হওয়ায় তাকে ১০০ পাউন্ড ‘হোপ প্রাইজ’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
১৮৮৮ সালে দেশে ফেরেন পি সি রায়। পরের বছর সহকারী অধ্যাপক হিসেবে প্রেসিডেন্সি কলেজে যোগ দেন। শুরু হয় তার শিক্ষক, গবেষকজীবন ও বিভিন্ন সামাজিক কাজ। ঘি, সরিষার তেল ও বিভিন্ন ভেষজ উপাদান নিয়েই তিনি প্রথম গবেষণা শুরু করেন।
১৮৯৫ সালে তিনি মারকিউরাস নাইট্রাইট (HgNO2) আবিষ্কার করেন। যা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। এটি তার অন্যতম প্রধান আবিষ্কার। এ ছাড়া পারদ-সংক্রান্ত ১১টি মিশ্র ধাতু আবিষ্কার করে তিনি রসায়নজগতে বিস্ময় সৃষ্টি করেন। গবাদি পশুর হাড় পুড়িয়ে তাতে সালফিউরিক এসিড যোগ করে তিনি সুপার ফসফেট অব লাইম তৈরি করেন। তার প্রথম মৌলিক গবেষণা খাবারে ভেজাল নির্ণয়ের রাসায়নিক পদ্ধতি উদ্ভাবন-সংক্রান্ত।
১৯১১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট প্রতিনিধি হিসাবে তৃতীয়বারের মত তিনি ইংল্যান্ড যান এবং সেখান থেকেই সিআইই লাভ করেন।
১৮৮৯ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি কলেজের শিক্ষক ছিলেন। এরপর ১৯৩৬ সাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ১৯৩৭ সালে ৭৫ বছর বয়সে তিনি যখন পরিপূর্ণ অবসর নিতে চাইলেন, তখন তাকে আমৃত্যু অধ্যাপক (Emiritius Professor) হিসেবে রসায়নের গবেষণাকর্মের সঙ্গে যুক্ত রাখা হয়।
ব্রিটিশ সরকার ১৯৩০ সালে তাকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেন। এ ছাড়া একই বছর লন্ডনের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৩৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত বর্ষের মহীশুর ও বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেন।
এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই ১৮৮৫ সালে সিপাহী বিদ্রোহের আগে ও পরে (India Before and After the Sepoy Mutiny) এবং ভারতবিষয়ক বিভিন্ন নিবন্ধ লিখে ভারতবর্ষ এবং ইংল্যান্ডে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
পি সি রায় ১২০০ শতাব্দী এবং তারও পূর্বের ভারতবর্ষের রসায়ন চর্চার ইতিহাস তুলে ধরে প্রমাণ করেন যখন ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ গাছের ছাল বা বাকল পরে লজ্জা নিবারণ করতো, তখন ভারতবর্ষের মানুষ পারদের ব্যবহার সম্পর্কে অবগত ছিলো। বিজ্ঞানের উপর ১৫০ গবেষণা গ্রন্থ পৃথিবীর বিভিন্ন র্জানাল মিউজিয়ামে স্থান পেয়েছে।
পি সি রায় ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। ছাত্রদের সঙ্গে ছিল তার নিবিড় সম্পর্ক। তিনি ছিলেন চিরকুমার। ছাত্রছাত্রীরাই ছিল তার ছেলে মেয়ে। তিনি বুঝেছিলেন বাংলায় বক্তৃতা ছাত্রদের অনুধাবনের পক্ষে সহায়ক। তাই ক্লাসে বাংলায় বক্তৃতা দিতেন এবং পড়ার সময় বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানী ও বিখ্যাত বাক্তিদের জীবনকাহিনী এবং তাদের সফলতার কথা তুলে ধরতেন। তার বাচনভঙ্গী ছিল অসাধারণ, তিনি ছাত্রদের মন জয় করে নিতেন খুব সহজেই। বিজ্ঞান কলেজে যোগ দিয়ে তিনি কলেজেরই দোতলার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের একটি ঘরে থাকতেন। ছাত্ররাই তার দেখাশুনা করতো। যেসব ছেলেরা তারকাছে থাকত, তাদেরই একজনের হাতে মাথা রেখে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তার বিখ্যাত ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, নীলরতন ধর, পুলিন বিহারী সরকার, রসিকলাল দত্ত, মেঘনাদ সাহা, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, বিজ্ঞানী কুদরত-ই খুদা, হেমেন্দ্র কুমার সেন, বিমান বিহারী দে, প্রিয়দা ভঞ্জন রায়, জ্ঞানেন্দ্র নাথ রায়, জ্ঞানেন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায়, রাজেন্দ্র লাল দে, প্রফুল্ল কুমার বসু, বীরেশ চন্দ্র গুহ, অসীমা চ্যাটার্জি প্রমূখ।
একবার ফজলুল হক (শের-এ বাংলা) ৫/৬ দিন ক্লাসে না আসলে একদিন বিকালে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তার বাসায় যান। ফজলুল হক তখনও খেলার মাঠে থাকায় তিনি তার জন্য অপেক্ষা করেন। ফজলুল হক ফিরে এসে স্যারকে দেখে তিনি কতক্ষণ এসেছেন জানতে চাইলে বলেন ‘তোমাদের হিসেবে এক ঘন্টা আর আমার হিসেবে ষাট মিনিট’।
বিজ্ঞান শিক্ষার পাশাপাশি প্রফুল্লচন্দ্র তার ছাত্রদের নৈতিক স্বাদেশিক শিক্ষাতেও দীক্ষিত করেছিলেন। তিনি তার ছাত্রদের বলতেন, ‘গরীব মানুষের পয়সায় লেখাপড়া শিখছো, এদের ঋণের বোঝা কিন্তু একদিন ফিরিয়ে দিতে হবে।’ ছাত্রদের নিয়ে তিনি বন্যা মহামারী দুর্ভিক্ষ- সব সময়ই আর্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
একজন বিপ্লবী ও দেশপ্রেমিক : দেশপ্রেম তাকে ইউরোপে থেকে দেশে ফিরিয়ে এনেছিল। বাংলা ভাষা তার অস্তিত্বের সাথে মিশে ছিল এবং তিনি ক্লাসে বাংলায় লেকচার দিতেন। বৃটিশ গোয়েন্দা দপ্তরে স্যার পি সি রায়ের নাম লেখা ছিল ‘বিজ্ঞানী বেশে বিপ্লবী’। তিনি স্বদেশি আন্দোলনের প্রথম পর্যায় থেকেই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। ১৯০৫ এ বঙ্গভঙ্গর ঘোষণাকে কেন্দ্র করে যখন বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলন সক্রিয় হয়ে ওঠে, তখন গোপনে অস্ত্র ক্রয়ের জন্য তিনি বিপ্লবীদের অর্থ সাহায্য করতেন। ১৯১৬ সালে কলকাতায় তিনিই প্রথমবারের জন্য মহাত্মা গান্ধীর জনসভার আয়োজন করেছিলেন।
১৯১৯ সালে কলকাতার টাউন হলে রাউলাট বিলের বিরোধিতায় আয়োজিত জনসভায় ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বলেন, ‘দেশের জন্য প্রয়োজন হলে বিজ্ঞানীকে টেস্ট টিউব ছেড়ে গবেষণাগারের বাইরে আসতে হবে। বিজ্ঞানের গবেষণা অপেক্ষা করতে পারে, কিন্তু স্বরাজের জন্য সংগ্রাম অপেক্ষা করতে পারে না।’
গান্ধীজির অনাড়ম্বরপূর্ন জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি নিজেকে কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত করেছিলেন। ১৯২৫ সালের জুনে অসহযোগ আন্দোলন প্রচারে গান্ধীজি খুলনায় আসলে সাতক্ষীরা জেলার তালার সৈয়দ জালাল উদ্দীন হাসেমী ও ডুমুরিয়ার মাওলানা আহম্মদ আলীকে সঙ্গে নিয়ে পি সি রায় স্টিমার ঘাটে তাকে স্বাগত জানান। পি সি রায় ছিলেন সম্বর্ধনা কমিটির সভাপতি।
১৯২৫ সালে কোকনাদ কংগ্রেসের কনফারেন্সে সভাপতি মাওলানা মোহাম্মদ আলীর অনুপস্থিতে কিছু সময় স্যার পি সি রায় সভাপতিত্ব করেন। একই সময় পাইকগাছা উপজেলার কাটিপাড়ায় ‘ভারত সেবাশ্রম’ নামে একটা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে নিজ জন্মভূমির এলাকার মানুষকে চরকায় সুতো কাটার মাধ্যমে স্বদেশি আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেন। বিজ্ঞান কলেজের বারান্দায় একটা চরকা স্থাপন করে তিনি নিজেও সুতা কাটতেন। ১৯৩০ সালে কংগ্রেসের লবন আইন অমান্য আন্দোলনের খুলনা জেলার স্থান হিসেবে পি সি রায় নিজ গ্রাম রাঢ়ুলিকে নির্বাচন করেন্।
উদ্যোক্তা পিসি রায় : ভারত উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশ ছিল ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক কলোনি ও ব্রিটিশ পণ্যের বাজার। এ দেশের মানুষের নিজস্ব কোন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ছিল না। পি সি রায় উপলব্দি করলেন এদেশকে বাঁচাতে হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও ব্যাবসা বাণিজ্যের প্রসারের জন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার বিকল্প নেই। তিনি ঝাপিয়ে পড়লেন মানুষকে উদ্বুদ্ধ ও সহায়তা করতে, যাতে তারা শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ভারত উপমহাদেশে যত নামকরা শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে তার সূচনা ঐ সময়ের বলে ধারণা করা হয়।
১৮৯৩ সালে পি সি রায় নিজের ল্যাবরেটরিতে ব্রিটিশ কোম্পানি ফার্মাকোপিয়ার একটি ওষুধ তৈরির ব্যবস্থা করেছিলেন। এ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে মাত্র ৮০০ টাকা পুঁজি নিয়ে প্রতিষ্ঠা হয় বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস। যা ১৯০১ সালে কলকাতার মানিকতলায় ৪৫ একর জমিতে স্থানান্তরিত করা হয়। বর্তমানে ঐ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন শাখায় কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ১ লাখ। নিজ জেলা শহর খুলনায় মানুষের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন এ পি সি কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি ও এ পি সি টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড (পরবর্তীতে খুলনা টেক্সটাইল মিলস)।
১৯০৬ সালে তিনি রাঢ়ুলি এবং এর আশপাশের গ্রামের মানুষকে জড়ো করে ৪১টি কৃষি ঋণদান সমবায় সমিতি গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে সমিতিগুলো নিয়ে রাঢ়ুলি সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন, যা ছিল অবিভক্ত বাংলায় তৃতীয় ব্যাংক।
১৯২৩ সালে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় ধর্মগোলা ও সমবায় ভান্ডার স্থাপনের পরামর্শ দেন। ১৯১৭ সালে বেঙ্গল কেমিক্যাল সমবায় সমিতি, ১৯১৮ সালে বঙ্গবাসী কলেজ কো-অপারেটিভ ষ্টোর এন্ড কেন্টিন, ১৯২১ বেঙ্গল কো-অপারেটিভ সোসাইটি সহ অনেক সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়া একাধিক কাপড়ের মিল ও অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে প্রতিষ্ঠা করতেও রেখেছেন বিশেষ ভূমিকা।
শিক্ষাবিস্তারে নিবেদিত প্রাণ : চিরকুমার পি সি রায়ের জীবন ছিল অনাড়ম্বর। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমিদারি সম্পত্তি ও তার উপার্জিত সমুদয় অর্থ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে, ছাত্রবৃত্তি ও জনহিতকর কাজে দান করে গেছেন। পি সি রায় শুধু নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই প্রতিষ্ঠা করেননি, সেই সময়ে প্রতিষ্ঠিত এমন কোন প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে পিসি রায় এর অর্থনৈতিক অনুদান ছিল না।
আর কে বি কে হরিশ চন্দ্র ইনষ্টিটিউট (বর্তমানে কলেজিয়েট স্কুল)
চারটি গ্রামের নাম মিলে ১৯০৩ সালে তিনি দক্ষিণ বাংলায় প্রথম আর কে বি কে হরিশ চন্দ্র ইনষ্টিটিউট (বর্তমানে কলেজিয়েট স্কুল) প্রতিষ্ঠা করেন। নিজের রাঢ়ুলি গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন যশোর-খুলনার প্রথম বালিকা বিদ্যালয় ভুবন মোহিনী বালিকা বিদ্যালয়। বাগেরহাট পিসি কলেজ তারই কীর্তি। সাতক্ষীরা চম্পাপুল স্কুলও পি সি রায়ের অর্থানুকূল্যে প্রতিষ্ঠিত। খুলনার দৌলতপুর বিএল কলেজ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ, বরিশালে অশ্বিণী কুমার ইনষ্টিটিউশন, যাদবপুর হাসপাতাল, চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতাল সহ প্রায় অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠানে তিনি আর্থিক অনুদান দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও পি সি রায় ১৯২৬ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত ১ লক্ষ ৩৬ হাজার টাকা দান করে ছিলেন। এ সময় ছোট্ট একটি ছেলে অর্থের অভাবে পড়াশোনা চলেছে না এমনটা লিখে পি সি রায়ের কাছ চিঠি লেখেন। তিনি তখনই পোস্টকার্ড লিখে ছেলেটিকে আসতে বলেছিলেন।
ভুবন মোহিনী বালিকা বিদ্যালয়
মানব সেবায় পিসি রায় : যেখানেই মানুষের দুর্ভোগ, সেখানেই তিনি। অর্জিত সব অর্থ অকাতরে দান করেছেন। ১৯১৯ ও ১৯২০ সালে পর পর দুই বছর অনাবৃষ্টির কারণে সমগ্র খুলনা (বর্তমান খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলা) জেলায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং পরবর্তীতে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ১৯২১ সালে গড়ে তোলেন রিলিফ কমিটি। ১৯২২ সালে উত্তরবঙ্গে ভয়াবহ বন্যা হলে সেখানেও ছুটে যান তিনি। সেখানকার মানুষকে রক্ষায় গঠিত ত্রাণ কমিটিরও সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি।
অসাম্প্রদায়িক পিসি রায় : পিসি রায় শুধু নিজে অসাম্প্রদায়িকই ছিলেন না বরং সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার মূলোৎপাটনের জন্যও চেষ্টা করেছেন সবসময়। পিতার মত তিনিও ছিলেন আরবী ও ফার্সী ভাষায় বিশেষ দক্ষ। তাদের বাড়ির বিশাল লাইব্রেরিতে অনেক ইসলামী ও হিন্দু ধর্মীয় বই পুস্তক ছিল। তাদের বাড়িতে সার্বক্ষণিক একজন বৃদ্ধ মৌলভী সাহেব নিযুক্ত ছিলেন।
১৯১৫ সালে কুদরত-ই খুদা (একমাত্র মুসলিম ছাত্র) এমএসসি তে (রসায়ন) প্রথম শ্রেণি পাওয়ায় কয়েকজন হিন্দু শিক্ষক তাকে অনুরোধ করেন প্রথম শ্রেণি না দেওয়ার জন্য। অনেকের বিরোধিতা সত্ত্বেও পিসি রায় নিজের সিদ্ধান্ত মোতাবেক কুদরত-এ-খুদাকে প্রথম বিভাগ দেন।
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ছিলেন তার অতি প্রিয় ছাত্র। নির্বাচনের সময় নির্বাচনী মিছিলে বৃদ্ধ বয়সে খোলা ঘোড়ার গাড়িতে দাঁড়িয়ে জনগণকে ফজলুল হককে জয়ী করার জন্য কলকাতাবাসীকে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন এই বলে ফজলুল হক পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত খাঁটি মুসলমান।
মানুষের মুখে মুখে নানা গল্প : বিজ্ঞানী পি সি রায়কে নিয়ে তার নিজ গ্রাম ও আশপাশের গ্রামগুলোতে মানুষের মুখে মুখে নানা গল্প প্রচলিত আছে। জানা যায়, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তাকে কেনার জন্য অর্থাৎ ব্রিটিশদের হয়ে কাজ করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তবে তিনি তো ছিলেন দেশপ্রেমিক, সেটা মেনে নিতে পারেননি। তাই তিনি রসিকতার সাথে বলেছিলেন, আমাকে কিনতে হলে তো আমার মাথা কেটে নিয়ে যেতে হবে। তাহলে আমার মাথা কেটে নিয়ে যান ।
বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া একসময়ের কপোতাক্ষ নদ
আরও জানা যায়, একবার এক বুড়ি কাটিপাড়া বাজারে লাউ বিক্রি করতে এসে পিসি রায়ের নজরে পড়েন। পরে সেই লাউ গাছের গোঁড়া থেকে তিনি সোনা খুঁজে বের করেন। পিসি রায় প্রায়সময়ই কপোতাক্ষ নদের ধারে কান পেতে শুয়ে থাকতেন। সুন্দরবন উপকুলে অনেক কিছু আছে তার ইঙ্গিতও দিয়ে গিয়েছিলেন, তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকেরা সেটা জেনে সুন্দরবন এলাকায় নাকি বিশেষ অভিযানও চালিয়ে ছিল।
ব্যতিক্রমধর্মী মানুষ : একবার ভারতের অবস্থা জানার জন্য ইংল্যান্ডে একটা কমিশন (সাইমন কমিশন) গঠন করা হয়। লন্ডনেই তারা কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের অনেক সুনাম শুনেছেন। তারা আরও জানতে পারেন বিজ্ঞান কলেজে একজন মনীষা আছেন এবং তারা বিজ্ঞান কলেজ পরিদর্শনে আসতে চাইলেন। একদিন দুপুরের দিকে কমিশনের সদস্যরা বিজ্ঞান কলেজে এলে দেখেন পিসি রায় গামছা পরে ধুতিখানা রোদে শুকাচ্ছেন। ঘরে ঢুকে দেখেন এক কোণে স্টোভে রান্না হচ্ছিল। অন্যদিকে সাদামাটা একটা খাট। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল আর একটা সাধারণ চেয়ার। পোশাক রাখার জন্য একটা কমদামি আল্না। ঘরের অবস্থা দেখে তাদের বিস্ময়ের মাত্রা আরো বেড়ে যায়।
শুধু বিজ্ঞান নয়, সাহিত্যের প্রতিও ছিল তার গভীর আগ্রহ। সেক্সপিয়র ছিলেন তার প্রিয় নাট্যকার। হ্যামলেট নাটক গোটাটা তিনি মুখস্থ বলতে পারতেন। রবীন্দ্রনাথের প্রতিও তার ভক্তি কম ছিলনা। তিনি আবার জগদীশ চন্দ্র বসুরও সহকর্মী ছিলেন।
শেষ নিঃশ্বাস : ৭৫ বছর বয়সে তিনি অধ্যাপক হিসেবে অবসর নেওয়ার পরও আট বছর বেঁচে ছিলেন। সেই সময়ও কেটেছে বিজ্ঞান কলেজের ওই ছোট কক্ষে। শেষ জীবনে তার স্মৃতি শক্তি লোপ পেয়েছিলো,স্পষ্ট করে কথা বলতে পারতেন না, এমন কি নিজের বিছানা ছেড়ে উঠে বসতে পারতেন না। যেসব ছেলে তাঁর কাছে থাকত, তাদেরই একজনের হাতে মাথা রেখে তিনি ১৯৪৪ সালের ১৬ জুন মাত্র ৮৩ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তার মৃত্যুর খবর পেয়ে শের-এ-বাংলা ফজলুল হক, মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দীন, শিক্ষামন্ত্রী নাজিম উদ্দীন খান, মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি ও অন্যান্য বিশিষ্টজনেরা ছুটে যান শেষ বারের মতো দেখার জন্য।
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS